সিমলিপাল ও খৈরি
-শচীদুলাল পাল
আমি তখন ওড়িশা সরকারের জয়েন্ট সেক্টারের ইষ্ট কোস্ট কেমিক্যাল এন্ড ফার্টিলাইজার লিমিটেডের রাসায়নিক কারখানায় সিফট ইনচার্জ পদে চাকুরী নিয়ে ময়ূরভঞ্জ জেলার কলমাতে জয়েন করেছি। নির্মীয়মান কারখানায় তখন প্রজেক্টের কাজ চলছে। তাই আমার কোনো কাজ নেই। কারখানার ভিতরেই থাকতাম।
কারখানার বাউন্ডারি ওয়ালের পর থেকে জঙ্গল শুরু। কর্তৃপক্ষ এক আদিবাসী ছেলেকে আমার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের জন্য যুক্ত করেছে। নাম তার সাপলা। একদিন বললাম- সাপলা আমি সিমলিপাল জঙ্গল দেখতে যাব। এই দেখ আজকের ম্যাগাজিনে খৈরি বাঘের ছবি বেরিয়েছে। খৈরিকেও দেখে আসব।
সাপলা বলল- ঠিক আছে বাবু, চলুন কবে যাবেন বলুন। আমার ঘরে একরাত থাকবেন। আমার দাদা ফরেস্ট গার্ডের চাকরি করে। সে তার বসকে বলে জঙ্গল সফরের গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে। বন্য জন্তু জানোয়ার আছে। সাফারি গাড়ি ছাড়া সেখানে ঢুকবার অনুমতি নাই। একদিন আদিবাসী ছেলেটির সাথে বেরিয়ে পড়লাম। সে প্রথমে জঙ্গল সংলগ্ন তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেল। শাল পিয়ালের গাছে ভরা গাঁ। গাঁ না বলে আদিবাসী পাড়া বলাই ভালো। তিনদিকে বন।একদিক মেঠো পথ দিয়ে সড়কের সাথে যুক্ত।
মাটির ঘরে পুয়ালের ছাউনি। সুন্দর নিকানো দেওয়াল। আসার সময় বড় রাস্তা থেকে মেঠো পথে যেতে যেতে দেখলাম একটা খরগোশকে বুনো শিয়াল তাড়া করেছে। সে প্রাণের ভয়ে ছুটছে। একটা ডোবাতে অজস্র সাপ কিলবিল করছে। ধান উঠে যাওয়া ক্ষেতে একটা গোসাপ। কতগুলো উলঙ্গ শিশু গোসাপটিকে ধরবার চেষ্টা করছে। এই গোসাপটিকে মেরে তার মাংস রান্না করে খাবে। জঙ্গলের মেঠো পথ ধরে এক সাপুড়ে সাপের খেলা দেখিয়ে ফিরছে। সাপলা বলল- বাবু সাপের খেলা দেখবেন? আমি বললাম- হ্যাঁ।
সাপুড়েটি তার আত্মীয়।
সাপলা আমার জন্য সাপের খেলা দেখাতে লোকটিকে অনুরোধ করল।
ক্ষেতের ধারে সাপের খেলা দেখাতে দেখাতে সাপুড়ে বলল- এই সাপ ছ’ ফুট লম্বা এক মানুষের কপাল ছুঁয়ে দিতে পারে। শুধু দাঁতে নয় তার ল্যাজেও বিষ। ল্যাজ দিয়ে কাউকে ছুঁয়ে দিলেও সাথে সাথেই মরে যাবে। আমরা একে রানা সাপ বলি, সাপটিকে গত সপ্তাহে ময়ূরভঞ্জ জঙ্গল থেকে ধরেছি।
সাপলা বলল- এই বিশাল সাপের বিষ খুব তীব্র ও পরিমাণে অনেক বেশি। কাকা এই সাপের বিষ বিক্রি করে অনেক টাকার মালিক। কলকাতা থেকে বাবুরা এসেও নিয়ে যায়।
কার্তিকের নাতিশীতোষ্ণ বাতাবরণে অপূর্ব লাগছে, স্নিগ্ধ হাওয়া। দূরের রক্ত রাঙা সূর্য অস্ত যাবে। রক্তিম আভা ঠিকরে পড়ছে বনবীথিকায়।
আমরা সাপলার ঘরে পৌছলাম। বাড়ির লোকজন আমাকে দেখে আড়ষ্ট হলেও পরে সাপলার কাছ থেকে আমার পরিচয় জেনে খুব আদর যত্ন করল। খুব সহজ সরল মানুষ তারা। বনের রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে পড়ে গিয়ে আমার পায়ে চোট লেগেছিল। বাড়ির মেয়েরা এসে গাছের পাতা শিকড় বাকড়ের নির্যাস থেকে তৈরি তেল দিয়ে মালিশ করে দিল। পায়ের ব্যথা নিমেষে উধাও। সাপলার অনুরোধে ঘরের তৈরি মহুয়ার নির্যাস পান করলাম।
ঘরে পোষা মুরগির মাংস দিয়ে ভাত দিল। খেয়েদেয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লাম। মুরগির ডাকে,পাখিদের কলকাকলীতে, প্রভাত সূর্যের নরম আলো চোখে পড়তে ঘুম ভাঙল।
আমরা জঙ্গল সফরের জন্য তৈরি হলাম। ঘুম থেকে উঠে সাপলা খরগোশ মেরে নিয়ে এসেছে। সেই খরগোশের মাংস আর পান্তাভাত দিয়ে আমরা প্রাতরাশ সারলাম।
বারিপদা বনকর্তা/ বনসংরক্ষক অফিস থেকে সাপলার দাদার সুপারিশে বনদপ্তরের অফিস থেকে দেওয়া গাড়িতে চেপে রওনা দিলাম সিমলাপাল সফরে।
আমরা জনা পাঁচেক গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম শিমলিপাল অরণ্যে। পাহাড়ি ঘন জঙ্গলের উঁচু নিচু চড়াই উৎরাই রাস্তায় একটা ছোট নদীকে পেরিয়ে রাস্তা। একছোট্ট আদিবাসী গ্রামের জারুলগাছ তলায় এসে গাড়ি থামল।
নদীর কাছে গাড়ি থেকে আমরা সবাই নামলাম। গাইড বলল- এই সেই খৈরি নদী। পাহাড়ি নদী। এসময় জল বেশি থাকে না। বর্ষায় দুকুল ছাপিয়ে বান আসে। ভীষণ খরস্রোতা। আপনাদের আজ এক বাস্তব কাহিনি বলব।
“বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”- কিন্তু এর ব্যতিক্রম যে হয় তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই সত্যি গল্প। ওই যে আদিবাসী গ্রাম দেখছেন সেই গ্রামের একদল আদিবাসী মধু সংগ্রহ করে ফিরছিল দেখল খৈরি নদীর ধারে এক বাঘিনী ও তার তিনটি বাচ্চা জল খাচ্ছে। একজন ছুটতে ছুটতে এসে গ্রামে খবর দিল বাঘ এসেছে খৈরির তীরে। গ্রামবাসীরা ড্রাম কানেস্তারার শব্দে বাঘিনীটিকে তাড়াবার চেষ্টা করতেই বাঘিনীটি তার দুটি বাচ্চাকে নিয়ে নদী পার হয়ে জঙ্গলে চলে যেতে সমর্থ হলেও এক দূর্বল বাচ্চা তার মায়ের সাথে যেতে পারলনা। গ্রামবাসীরা ফুটফুটে বাঘশিশুকে কোলে তুলে নিল। সেটি ছিল স্ত্রী বাঘ। সেই সময় সরকারি ফরেস্ট অফিসার (বনকর্তা) সরোজ রাজ চৌধুরী বন পরিদর্শনে গাড়ি নিয়ে টহল দিতে গিয়ে ড্রাম কানেস্তারার আওয়াজ শুনে নদীর ধারে গেলে গ্রামবাসীরা কুড়িয়ে পাওয়া সেই বাঘের বাচ্চাটিকে তার হাতে তুলে দিল। স্ত্রী- বাঘশিশুটি ছিলো ভীষণ দূর্বল। অফিসার পরম যত্নে গাড়ীতে উঠিয়ে নিজের বাংলোয় নিয়ে আসল।
তিনি তাকে গরম গুঁড়ো দুধ খাওয়ালেন। আদরে আবদারে ভরিয়ে দিলেন। রাতে দুধ রুটি খাইয়ে একসাথে বিছানায় ঘুমোলেন। পরদিন সকালে একসাথে স্নান করলেন। বাঘশিশুটি খৈরি নদীর ধারে পেয়েছিলেন বলে তার নাম রাখলেন খৈরি।খৈরি ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগল। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা পরিণত হল। খৈরি রজত রায় চৌধুরীর কাছে পরম যত্নে কোলে পিঠে মানুষ হতে লাগল।একটু বড়ো হলে তাকে ডাল ভাত সবজি গুড়ো দুধ ও পাঁঠার মাংস রান্না করে খাওয়াতে হত। একসাথে এক বিছানায় খৈরি রজত বাবুকে কোল বালিশের মতো জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো। এভাবে না শুলে তার ঘুম আসতো না। বন সফরে গেলে তাকে সাথে নিয়ে যেতে হত। কিন্তু অফিসিয়াল কাজে শহরে গেলে সবাই ভয় করতো। অফিসিয়াল কাজে ভীষণ অসুবিধা হতো। তাই অন্য সময়ের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তার এক মহিলাকে নিযুক্ত করলেন। তার নাম ছিল নীহার নলিনী সোয়াইন। তাদের দুজনের আদরে যত্নে খৈরি হয়ে উঠল এক বিশালাকৃতির রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তার ওজন হল ২০০ কেজি।
পরে নীহার নলিনী সোয়াইনের সাথে সরোজ রায় চৌধুরীর বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ে হলে কি হবে?
খৈরিকে আলাদা ঘরে রেখে এক বিছানায় দম্পতি শুতে গেলে ভীষণ জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিতো। গর্জন করতো। সারারাত কাউকে ঘুমাতে দিতোনা। অবশেষে তাকে দুজনের মাঝখানে রেখে শুতে হতো। কিছুদিন পর তাও তার সহ্য হত না। ঠিক হল তাকে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হবে। সেই মতো তাকে অনেক দূরের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসল রজতবাবু।
বিকেলে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। হঠাৎ সরোজ বাবু দেখলেন আঙিনায় খৈরি দাঁড়িয়ে আছে। দুচোখে তার জলের ধারা। পরম স্নেহে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে এলেন। নলিনীও অনেক অনেক চুমু দিয়ে আদর করতে লাগল।
বন্য প্রাণীদের থাকার জন্য যশিপুরে তাদের সরকারি বাসস্থানে আরও বেশ কিছু বন্য প্রাণী পুষেছিলেন। একটি কুমির, জাম্বু নামে একটি ভালুকের বাচ্চা, বাইনা নামে একটি অন্ধ হায়না এবং একটি মঙ্গুস পুষেছিলেন। তাদের সকলেই তার আঙ্গিনায় অবাধে ঘুরে বেড়াত ।
সরোজবাবুর পোষা কুকুর ব্ল্যাকির সঙ্গেই বড়ো হচ্ছিল খৈরি। এমনকি নানা জায়গা থেকে সরোজবাবু বন্য বিড়াল কিংবা হরিণ শাবক উদ্ধার করে নিজের দায়িত্বে লালন-পালন করতেন, খৈরি তাদের সঙ্গেও থাকতে পছন্দ করতো। তিনি লক্ষ করেছেন, হরিণটিকে বা কুকুরকে যখন নীহার খাইয়ে দিতো, সে সময় ঈর্ষান্বিত হতো খৈরি। সরোজ রাজ চৌধুরী খুব কাছ থেকে খৈরির আচার-ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করতেন, বিশেষত বাঘেদের ফেরোমোন নিঃসরণের পদ্ধতি কিংবা বাঘেদের মিলনের সময়কালীন আচরণ ইত্যাদিও পর্যবেক্ষণ করতেন। পরবর্তীকালে খৈরিকে নিয়েই বিখ্যাত বিজ্ঞানী রতনলাল ব্রহ্মচারী ফেরোমোন নিঃসরণ সংক্রান্ত গবেষণা করেছিলেন এবং প্রাণীদের ফেরোমোনে বিশেষ তীব্র সুবাসের কারণ হিসেবে ২-এপি নামের একটি রাসায়নিক যৌগ অণুর উপস্থিতি আবিষ্কার করেন। খৈরির সঙ্গে পরিচয়ের বহু আগে থেকেই সরোজ রাজ চৌধুরী বাঘের পায়ের ছাপ দেখে বাঘগণনার পদ্ধতি চালু করেছিলেন, ২০০৪ সাল পর্যন্ত ভারতে এই পদ্ধতিতেই বাঘ গণনা করা হত। ১৯৭২ সালে ভারতে প্রথম এই পাগমার্ক মেথডোলজির সাহায্যে বাঘ গণনা করা হয়। তাছাড়া তাঁরই উদ্যোগে ফরেস্ট অফিসারদের বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ে আরো দক্ষ করে তুলতে ‘প্রোজেক্ট টাইগার’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে এই খৈরিই হয়ে ওঠে সরোজ রাজ চৌধুরীর অতিপ্রিয় বাঘিনী। তবে শুধুই ভালোবাসার খাতিরে খৈরির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক।
একদিন সরোজ রায় চৌধুরী হাবভাব ও লক্ষ্মণ দেখে লক্ষ্য করলেন খৈরির প্রজনন প্রয়োজন। প্রজজনের জন্য প্রস্তুত।তিনি একদিন গভীর বনে বাঘেদের দলে তাকে ছেড়ে দিলেন। লক্ষ করলেন সে বাঘদের গন্ধ সহ্য করতেই পারছে না। অদুরে সরোজ বাবুর ক্লোজ ভ্যান খুঁজে সেখানে উপস্থিত খৈরি। খৈরি গর্ভধারণ করতে পারেনি।
সরোজ রাজ চৌধুরী ছিলেন একজন ভারতীয় পরিবেশবাদী, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবাদী, লেখক এবং ওড়িশা সরকারের অধীনে প্রথম বন সংরক্ষক ও গবেষক। তিনি ভারতের ওড়িশা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ জেলার সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকও ছিলেন। চৌধুরী বাঘ শুমারি এবং খৈরি নামে গৃহপালিত বাঘের সাথে তার বন্ধুত্বের জন্য নিযুক্ত পাগমার্ক কৌশলের জন্য পরিচিত ছিলেন । ১৯৭৭ সালে তার লেখা একটি বই, খৈরি দ্য বেলভড টাইগ্রেস, প্রকাশিত হয়।
১৯৮৩ সালে ভারত সরকার তাকে চতুর্থ সর্বোচ্চ ভারতীয় বেসামরিক সম্মান “পদ্মশ্রীতে” ভূষিত করেন। সরোজ রাজ চৌধুরী, ওড়িশায় জন্মগ্রহণ করেন, ওড়িশা সরকারের চাকরিতে একজন বন কর্মকর্তা হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন এবং একজন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা হওয়ার পদে উন্নীত হন, তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত প্রথম ব্যক্তি। পরবর্তীতে, তাকে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান হিসেবে বদলি করা হয়, যা ১৮৭৮ সালে জার্মান বনবিদ, ডিট্রিচ ব্র্যান্ডিস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । যখন সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভ ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন চৌধুরীকে এর প্রতিষ্ঠাতা ফিল্ড ডিরেক্টর এবং প্রজেক্ট টাইগারের প্রধান করা হয় যার সদর দপ্তর বারিপাদায় ।
গাইডের মুখে খৈরি, রজতবাবু ও নলিনীর কাহিনী শুনতে শুনতে পথ চলা শুরু করলাম। কখনো গাড়িতে কখনো পায়ে হেঁটে চলেছি দল বেঁধে। মাঠ, আল পেরিয়ে ঢুকলাম ঘন জঙ্গলের পাহাড়ি পথে।
রাস্তা এত সংকীর্ণ পিচ্ছিল ও জায়গায় জায়গায় ঢালু যেকোনো সময় যে কেউ পা পিছলে পড়ে যেতে পারে। কেউ যেন এগিয়ে চলে না যায়- গাইডের এই সর্তকবার্তা শুনে এগিয়ে চললাম।
অরণ্যে অল্প একটু কথা বললেই তা অনেক জোরে মনে হচ্ছে, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
আর জঙ্গল বলে কথা, তাও যে সে জঙ্গল নয় সিমলিপাল। তাই যতটা সম্ভব সর্তকতা অবলম্বন করে অবশেষে তিন কিলোমিটার হাঁটার পর পৌঁছালাম অসুর মারা ফলস। অপরূপ এই জলপ্রপাত, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আপন গতিতে নেমে আসছে। ঐ পথ দিয়ে উৎস পর্যন্তও যাওয়া যায়, ওখানকার দৃশ্য নয়নাভিরাম, কিন্তু যাত্রা পথ পিচ্ছিল, আরও দুর্গম । যাইহোক কিছুটা তো চড়লাম। যাত্রাপথে জলপ্রপাতের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মোহিত হলাম।
জলপান করে ফিরে চললাম কুমারীর উদ্দেশ্য।
গাড়ীর সামনে ফিরে ভরপেট জলখাবার খেয়ে সারাদিনের জন্য একে একে জঙ্গল পাহাড় ঘেরা উস্কিফলস, অপরূপ বরাপানি শেষে চাহালা ওয়াচ টাওয়ার।
বরাপানির অপরূপ সৌন্দর্য চারপাশে উঁচু পাহাড়ের শ্রেণী তার মধ্যে খানে গভীর খাদ।
এক উঁচু পাহাড় থেকে বুড়িবালাম নদী হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে বিপুল জলরাশিকে তীব্র গতিতে সশব্দে নিচে আছড়ে ফেলছে।
আহা! কি অপরূপ দৃশ্য! এক পলক বিশ্বাস করা কঠিন হচ্ছিল। ভালো করে যতটা দেখা যায় দেখে ফিরছিলাম।
রাস্তায় দুটো জায়গায় দেখলাম আমাদের গাড়ি যাবার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাক ক্যামেরার ফ্লাস জলে উঠল, বুঝলাম ওগুলো জঙ্গলের পশু অথবা কারা জঙ্গলে প্রবেশ করেছে তাদেরকে ওয়াচ করার জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই জঙ্গল বাঘ, কালোবাঘ, চিতা, জায়েন্ট স্কুইরাল, হাতি, হরিণ, সম্বর, বনশুয়োর, হায়না, গৌড় বা বুনো মোষ সহ নানা ধরনের বুনো জন্তুর বিখ্যাত। আর আছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও সাপ। এখানকার মশা ম্যালেরিয়া রোগ-এর বাহক। তবে শীতকালে প্রকোপ নেই।
অবশেষে চাহালা পৌঁছে মনে একটু বল পেলাম, যাক লোকজন তো আছে,গভীর জঙ্গলে যেখানে জনমানুষের চিহ্ন নেই ।
পশু পাখি তো চিড়িয়াখানায় অনেক দেখেছি কিন্ত এই বন্য পরিবেশে তাদের দেখা পাওয়া খুবই দুষ্কর। তবে যতটুকু তারা আমাদের দেখা দিয়েছে তাতেই আমরা ধন্য। হাতি দেখার আশায় অপেক্ষা করতে করতে হাতির দেখা সেদিন পেলাম না শুধু যা দেখতে গেছি মনের মনি কোঠায় সেই জঙ্গলকে রেখে দিনের আলোয় যে হরিণ কে দেখছিলাম তাদের জ্বলজ্বল করা চোখ আর ফ্লাশ লাইটের আলোয় হরিণের পালের ভীত পদচারনা দেখতে দেখতে পথ চলছি। এক জায়গায় ধস্তাধস্তির চিহ্ন দেখে বুঝলাম এখানে গতকাল বাঘ হরিণ মেরে খেয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
না! আর না! এবার ফেরার পালা। গাড়ির হেড লাইটের আলো জঙ্গলের বুক চিরে পাশে আবছা আলোছায়া তৈরি করতে লাগলো আর আমাদের ক্ষুধার্ত দু চোখ কিছু দেখতে পাবার আশায় চারধার নিরিক্ষন করতে করতে ফিরে চললাম আশ্রয়ে।
পরের দিন ঐ পাহাড়ি পথে সফরের অভিজ্ঞতা আকর্ষণীয়। বোল্ডার বিছানো প্রতিটি চড়াই উৎরাইয়েই মনে হচ্ছে এই বুঝি সামনে হাতি পড়বে, তখন কি করব? যাই হোক সেরকম কিছু হয়নি।
মুগ্ধকর চিরস্মরণীয় অপরূপ অবর্ণনীয় জোরান্ডা জলপ্রপাত দেখে মোহিত হলাম। সেখান থেকে খাদের দিকে তাকালে বুক কেঁপে উঠতে পারে। জঙ্গল খুব গভীর,হাতির উপদ্রব আছে,তারজন্য বিট অফিস সহ চারিদিকে ট্রেঞ্চ কাটা। আবার চলা এবার থামলাম এক পাহাড়ের মাথায় এটাই বোধহয় সিমলিপাল রেঞ্জের সব থেকে উচু অঞ্চল। এখান থেকে দুরে দেখা যাচ্ছে জোরান্ডাকে। এখানে নাকি “মামা”,মানে বাঘের উপদ্রব। তবু ফটো তুলতেই হবে, অতএব কিছুক্ষণ বিরতি।
পাহাড়ের চড়াই পথে সামনের গাড়িটা বাঁক নিয়ে ওপরে উঠেছে, বাঁকের মুখে নিচের ডান দিকের খাদে আমাদের নজরে পরলো একপাল হাতি।
আমাদের ড্রাইভার সামনের গাড়িকে দেখানোর জন্য ভুলবশত হর্ন দেওয়ায় চোখের নিমেষে ওরা ঘন জঙ্গলে চোখের আড়ালে চলে গেল। সামনের গাড়ি থেকে কয়েকজন চীৎকার করে ছুটে নেমে এসেছে তাদের তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠালাম।
বিশ্বাস নেই, এরা দলে থাকে যদি ওপরে কোন দল থাকে তাহলে সমূহ বিপদ। দু’দিক দিয়েই আমরা আটকে পড়বো। ওরা চাইলে আমাদের নিয়ে মনের আনন্দে ফুটবল খেলতে পারবে।
জঙ্গলে সবসময় চোখ কান খোলা রাখতে হয়। আর কোনরূপ অবাঞ্ছিত শব্দ করতে নেই। আর প্রত্যেককেই নজর রাখতে হয়। তবেই কিছু দেখা সম্ভব। এমনি করেই হরিণ, শুয়োর, বড় একটা পেঁচা, শিয়াল, হায়নার দেখা পেলাম।
প্রতি মুহূর্তেই মনে হতে লাগল সামনের বাঁক পেরোলেই লম্বা সোজা যে রাস্তা দেখা যাচ্ছে তার কোন এক জায়গায় যদি গাড়ির হেডলাইটের আলোয় “তার” দেখা পাই তো ষোলকলা পূর্ণ হবে।নিঝুম গভীর জঙ্গলে ভয়ার্ত হরিণের বাক বাক ডাক শুনলাম। কিন্তু তাকে মানে”মামাকে”দেখার সৌভাগ্য হল না। সামনে রাস্তা এগিয়ে যাচ্ছে। একটা তেমাথার মোড়,ডান দিকের রাস্তা চলে গেছে লুলুঙ্গের দিকে,ঐ জায়গাটাও দেখার মতো।
গাইড বলল- সামনে ওই যে ছোট্ট নদী দেখছেন ওটাই খৈরি নদী।
আমরা এবার বারিপদায় সরোজ রায় চৌধুরীর বাংলোয় উপস্থিত হলাম।
দেখলাম নলিনীকে। যিনি সন্তান স্নেহে মায়ের মতো খৈরিকে লালন পালন করে চলেছেন।সরোজ রায় চৌধুরী এক অফিসে কর্মরত। খৈরিকে দেখার বিশাল লম্বা লাইন। একটা নিদিষ্ট সময়ে দর্শনার্থীদের খৈরি সাক্ষাৎ দেয়। ২০০ কেজি ওজনের বিশালাকারের খৈরি এখন খাঁচায় রাখা হয়েছে। কাছে গিয়ে কোনো খাবার দেওয়া নিষিদ্ধ। চাক্ষুষ দর্শনের স্মৃতি চিরকাল মনে থাকবে। খৈরি দেখে আমি আমার কারখানার বাসস্থানে ফিরে এলাম।
বাঘিনী খৈরির পুরুষ বাঘের সাথে যৌনমিলনে অনীহা, মানুষের সাথে থাকতে থাকতে বাঘের গন্ধকে সে সহ্য করতে পারতো না।
তাই তার পিতামাতার (রজত- নলিনী) বারবার প্রজজনের জন্য প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।জঙ্গলে পুরুষ বাঘকে প্রত্যাখ্যান করে বাংলোয় ফিরে এসেছে। তাই এই কিংবদন্তি রয়েল বেঙ্গল টাইগার “খৈরি” কোনো বাচ্চার জন্ম দিতে পারেনি।
পরে সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছিলাম জঙ্গলের এক বুনো কুকুর বাংলোয় ঢুকে খৈরিকে আহত করে। তাই তাকে রেবিট ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল।
বাঘিনী জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। তখন ট্রানকুইলাইজারের অত্যধিক মাত্রায় খৈরির মৃত্যু হয়েছিল ১৯৮১ সালে, মাত্র ৭ বছর বয়সে। তার একবছর পর খৈরির শোকে মৃত্যু হয়েছিল পদ্মশ্রী সরোজ রায় চৌধুরীর। স্বামীর মৃত্যুর পর শেষের দিকে অপত্য স্নেহের “খৈরি”-র স্মৃতি বুকে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে কালযাপন করেন নলিনী।